কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার Kangal Horinath Mojumdar যিনি কাঙ্গাল হরিনাথ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন, প্রকাশক ও সম্পাদক গ্রামবার্তা প্রকাশিকা। জন্ম ১৮৩৩ সালে নদীয়া জেলার (বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা) কুমারখালী গ্রামে। পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। খুব ছোট বেলায় পিতা-মাতা হারান। পোত্রিক সম্পত্তি হতেও বঞ্চিত হন তিনি। ফলে প্রবল অভাব অনটন তার নিত্য সঙ্গী হয়ে যায়। দূর সম্পর্কের এক ঠাকুরমার কাছে মানুষ হন তিনি। ইংরেজী স্কুলে কিছুদিন পড়লেও অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়।
কাঙ্গাল হরিনাথ এর কর্মজীবন
পড়াশুনা বন্ধ হলে একটি নীলকুঠিতে কাজ নেন। নীলকুঠির সাহেবদের অসসতা, নিষ্ঠুরতা ও প্রজা নীপিড়ণ দেখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে নীলকুঠির কাজ ছেড়ে দেন হরিনাথ। এরপর এক মহাজনের গোমস্তার কাজ নেন। মহাজনের অন্যায় জুলুম দেখে সেখান থেকেও ইস্তফা দেন তিনি।
গ্রামের সাধারণ লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে বন্ধুদের সহায়তায় নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং অবৈতনিক শিক্ষকরুপে শিক্ষকতা শরু করেন। পরে তার সহায়তায় কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে কুমারখালী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত। বিদ্যালয়টিকে বাংলাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় বলে ধারণা করা হয়।
পড়াশুনা
অর্থাভাবে স্কুলে পড়াশোনা বন্ধ হলেও নিজের প্রচেষ্টায় প্রথাগত শিক্ষার বাইরে পড়াশুনা চালিয়ে যান তিনি। কুমারখালীতে ধর্মপ্রচারক দয়ালচাঁদ শিরোমণির কাছে ব্যাকরণ শেখেন। সাহিত্যিক অক্ষয়কুমার মৈত্রের পিতা মথুরানাথ মৈত্রের কাছে ক্ষেত্রতত্ত্ব, গণিত ও অন্যান্য বিষয় শেখেন। দয়ালচাঁদের কাছ থেকে “তত্ত্বাবোধনী” পত্রিকার সবকয়টি খন্ডও পড়ে নেন। ইশ্বরচন্দ্র সম্পাদিত “সংবাদপ্রভাকর” পত্রিকারও তিনি নিয়মিত পাঠক ছিলেন।
সাংবাদিকতা
সংবাদপ্রভাকর পত্রিকায় গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছোট ছোট প্রতিবেদন পাঠানোর মাধ্যমে হরিনাথ মজুমদারের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়। অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেশিত সাধারণ মানুষকে রক্ষার হাতিয়ার স্বরুপ কাঙ্গাল হরিনাথ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। নিজগ্রামের লোকের উপর জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচার, শাষন, জুলুম, নির্যাতনের কথা তিনি তুলে ধরেন সংবাদপ্রভাকর পত্রিকায়। ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কাঙ্গাল হরিনাথ কুমারখালী থেকে “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রথমে মাসিক কাগজ হলেও পরে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক আকারে প্রাকাশিত হতে থাকে। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সাথে জমিদার, নীলকর কর্তৃক সাধারণ মানুষকে অত্যাচার নির্যাতনের কথা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হতে থাকে গ্রামবার্তা প্রাকশিকায়। লালন ফকিরের গান গ্রামবার্তা প্রাকশিকাতেই প্রথম ছাপা হয়।
১৮৭৬ সালে গুরু মথুরনাথ মৈত্রের নামে কুমারখালীতে এম এম প্রেস নামে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম ছাপাখানা। কুমারখালীর কাঙ্গাল কুঠিরে ছাপাখানাটি এখনও আছে ইতিহাসের অংশ হয়ে।
সঙ্গীত ও সাহিত্যকর্ম
প্রায় দেড় যুগ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনার পর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ধর্ম সাধনায় মননিবেশ করেন। আধ্যাত্বিক গুরু ও সাধক লালন ফকিরের সাথে হরিনাথের সখ্যতা গড়ে উঠে এবং তার জীবন ধারণে লালনের চিন্তা চেতনার প্রভাব পড়ে। ১৮৮০ সালের দিকে তিনি নিজেস্ব একটি বাউল সঙ্গীতের দল প্রতিষ্ঠা করেন যা কাঙ্গাল ফকির চাঁদের দল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তার লেখা আধ্যাত্বিক গানের কথাগুলো সহজে বোধগম্য ও কাঙ্গাল ভণিতার সুরের ব্যবহার হওয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যেমনঃ
হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পাড় করো আমারে।
তুমি পারের কর্তা জেনে বার্ত্তা তাই ডাকি তোমারে।।
আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে।
যারা পরে এল আগে গেল আমি রইলাম পরে।।
গদ্য ও পদ্য রচনাতেও কাঙ্গাল হরিনাথ যথেষ্ঠ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বিজয় বসন্ত, চারু-চরিত্র, কবিতা কৌমুদী, কবি কল্প, চিত্ত চপলা তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্ম। হরিনাথের মোট আঠারোটি গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে।
হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে অক্ষরকুমার মৈত্র, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন সাহিত্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ক্ষণজন্মা এই লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ১৮৯৬ সালের ১৬ই এপ্রিল পরলোকগমণ করেন।
আরও পড়ুনঃ