বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ উপমহাদেশের যোগাযোগের ইতিহাসে এক অপূর্ব সৃষ্টি। ব্রিজটি কুষ্টিয়া জেলার ভোড়ামারা থেকে পদ্মা নদীর উপর দিয়ে পাবনা জেলার পাকশীকে সংযোগ ঘটিয়েছে।
ইতিহাসের স্বাক্ষি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
অবস্থান
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা ও পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলাধীন পাকশী উপনিয়নের মাঝে পদ্মা নদীর উপর অবস্থিত। ভেড়ামারা উপজেলা সদর হতে প্রায় ৮.৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং ঈশ্বরদী উপজেলা সদর হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা নদীর উপর সেতুটি অবস্থিত।
ব্রিজ নির্মাণের পটভূমি
পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ছিল সাঁড়া ঘাট, আর অপর পাড়ে দক্ষিণ তীরে ভেড়ামারার দামুকদিয়ায় রায়টা ঘাট। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গের সাথে শিলাগুড়ি মিটার গেজ রেলপথ স্থাপিত হওয়ার পর ভেড়ামারা উপজেলার দামুকদিয়া রায়টা ও সাঁড়াঘাটের মধ্যে নদী পারাপারের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু হয়। যার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের তরিতরকারি, মাছ-মাংশ, ডাল, ডিম প্রভৃতি কলকাতায় দ্রুত পৌছাতে পারতো।
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে পদ্মার পূর্ব তীরে সাঁড়াঘাট অন্যতম বৃহৎ ও ব্যাস্ত নদী বন্দরে পরিণত হয়। এ সময়ে দেশি-বিদেশি বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ, বার্জ, মহাজনী নৌকা ইত্যাদি ভিড়তো সাঁড়া বন্দরের ১৬ টি ঘাটে। সাঁড়া ছিল কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গ, শিলিগুড়ি ও আসামের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
ব্রিজ তৈরীর উদ্যোগ
যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি মিটারগেজ রেলপথ স্থাপিত হলে ভেড়ামারার দামুকদিয়া রায়টা ও সাঁড়া ঘাটের মধ্যে নদী পারাপারের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু হয়। যাত্রী ও মালামালের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার পদ্মা নদীর উপর ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব পেশ করে।
ব্রিজের নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাই
পদ্মা নদী তখন ছিল ভীষন খরস্রোতা। ১৮৮৯ সালে ব্রিজ তৈরির প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করে ম্যাচ এফ জে ইসিপ্রং একটি প্রতিবেদন তৈরী করেন। সাঁড়া ঘাটের দক্ষিণে ব্রিজ স্থাপনের সম্ভাব্যতার তথ্য সরকারের কাছে দেওয়া হয়। প্রতিবেদন মোতাবেক ১৯০৭ সালে পাকশীতে রেলব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়।
ব্রিজের নকশা প্রণয়ন
১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের অনুমোদনের পর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম এই প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার ইন চীফ হিসাবে দায়িত্ব পান। স্যার এস এম বেনডেলেগ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মূল নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯০৯ সালে প্রমত্ত পদ্মার উপর দিয়ে ব্রিজ নির্মাণের জরিপ কাজ শুরু হয়।
ব্রিজ নির্মাণ শুরু
১৯১০ সালে পদ্মার উপর ব্রিজ নির্মাণ শুরু হয়। নির্মাণ কাজের শুরুতে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে ব্রিজ রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিজ নির্মাণ করা ছিল অত্যন্ত দুরুহ কাজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করতে গিয়ে বিশ্বের প্রথম রিভার ট্রেনিং ও উভয় পাড়ে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। উজান থেকে ৪/৫ মাইল পর্যন্ত গাইড ব্যাংক নির্মাণ করা হয় ১৯১২ সালে।
ব্রিজের স্থান পরিবর্তন
বর্তমান ব্রিজের অবস্থান হতে প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে জিকে সেচ প্রকল্পের সামনে ১৯১০ সালে যেখানে ব্রীজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। ব্রিজের বেশ কিছু কাজ হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে স্থান পরিবর্তন করে উত্তর দিকে সরিয়ে বর্তমান স্থানে পূনরায় নির্মাণ করা হয়।
ব্রিজ নির্মাণ
১৯১২ সালে প্রায় ৮ কিলোমিটার উজান থেকে গাইড ব্যাংক বেঁধে এনে ব্রিজ নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয়। ব্রিটিশ রেলওয়ে বিভাগ পরের দুই বছর পুরোদমে কাজ করে ব্রিজটির নির্মাণ শেষ করেন। ২৪ হাজার শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নির্মাণকাজ শেষ করেন।
ব্রিজের নামকরণ
১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি মালবাহী বগি নিয়ে একটি ইঞ্জিন প্রথমে সেতু অতিক্রম করে। সোনা মিয়া নামক একজন চালক প্রথম ইঞ্জিন চালিয়ে ব্রিজ পাড়ি দেন। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড হাডিঞ্জ। তার নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের শুভ উদ্বোধন
১৯১৫ সালের ৪ মার্চ ব্রীজের উপর ডাবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহি ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। পরে এই ব্রিজের সাথে একটি দীর্ঘ ফুটপাত জুড়ে দেওয়া হয়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যত তথ্য
- ব্রিজটির প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার ফ্রান্সিস সপ্রীং।
- ব্রিজের ঠিকাদার ছিলেন ব্রেইথ ওয়াইট অ্যান্ড কার্ক।
- মোট স্প্যান ১৫ টি (দুই পাড়ে ৭৫ ফিট মধ্যবর্তী দুরত্বে ৩টি অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান আছে)
- মোট দৈর্ঘ ৫ হাজার ৮ শত ৯৪ ফুট
- ব্রিজ রক্ষা বাঁধের জন্য মাটির কাজের পরিমাণ দুই পাশ্বে ১৬ কোটি ঘনফুট।
- মোট ইটের গাথুনির কাজ হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার টন।
- মোট ইস্পাত ব্যবহৃত হয় ৩০ লাখ টন।
- মোট সিমেন্ট ব্যবহার হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম।
- নির্মাণে মোট ব্যায় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১ শত ৬৪ টাকা।
মুক্তিযুদ্ধে সেতুর ক্ষতি
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতুটিতে বোমা ফেলা হলে ১২ নং স্প্যানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর তা মেরামত করে পূণরায় ট্রেন চলাচল স্বাবাভিক করা হয়।
উপসংহার
অপরুপ সৌন্দর্য, অসাধারণ নির্মাণশৈলী আর তিন শাসকের সাক্ষী হয়ে শতবর্ষ পেরিয়ে আজও বীরদর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে হোর্ডিঞ্জ ব্রিজ। পদ্মার সেই ভরা যৌবন আর খরস্রোতা উত্তাল ঢেউ না থাকলেও চিরযৌবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মার বুজে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
২০০৪ সালে ব্রিজটির পাশ দিয়ে সড়কসেতু নির্মাণ করা হয় যার নাম রাখা হয় কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহরে নামে। নির্মাণের ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিবছর দেশি বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায় উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রীজটি স্বচক্ষে দেখতে।