কুষ্টিয়ার অতি পুরাতন কৃষি সরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থা রেণউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং লিঃ
সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে নদীবন্দর গড়ে উঠে। পরবর্তিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল ব্যবসার কাজে বন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। নীলচাষীদের সংখ্যাধিক্য ও নীলকরদের আগমনের পর এ এলাকায় নগরায়ন শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কুষ্টিয়া জেলার অর্থনীতিতে শিল্প কারখানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে।
১৮৬০ সালে কলকাতার সাথে কুষ্টিয়ার রেলযোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলগাড়ি চলাচল শুরু করলে এ অঞ্চলের ব্যবসায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের হাওয়া লাগে। কৃষি প্রধান অঞ্চল হওয়ায় এখানে কৃষি সরঞ্জাম নির্মাণ শিল্পের আদর্শ স্থানে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া কৃষকদের দুঃখ কষ্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পীড়িত করেছিল। কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষি কাজ সহজ করার বিষয়ে তিনি উদ্যোগি হয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে কুষ্টিয়া বড় রেল স্টেশনের দক্ষিণ দিকে টেগর লজের পাশে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে তিনি একটি কৃষি সরঞ্জাম নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করেন।
উনিশ শতকের শেষ দিকে রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম রেণউইক প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেণউইক অ্যান্ড কোম্পানি’ নামক আখমাড়াই কল তৈরির প্রতিষ্ঠান যার প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’।
প্রথম দিকে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ বেশ ভালোভাবে চললেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি ও অসাধুতার ফলে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাটের ব্যবসায়ে লক্ষাধিক টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এরকম সংকটাপন্ন সময়ে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ এর সাথে যুক্ত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরকুলের আত্বিয় খুলনার দক্ষিণডিঙ্গি গ্রামের একে উদ্যোগী তরুণ যজ্ঞেশ্বর সর।
যজ্ঞেশ্বরের অক্লান্ত চেষ্টায় কোম্পানির কিছুটা উন্নতি হলেও শেষরক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে যজ্ঞেশ্বরকে ‘কলকব্জা ও মালামাল’ দান করে দেন। এর সাথে ‘টেগর লজ’ এর পূর্ব দিকের দুই বিঘা জমিও বার্ষিক পঞ্চাশ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত করে দেন।
এই জায়গায় যজ্ঞেশ্বর ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে বিরাট এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এখানে আখ মাড়াই কল, নলকূপ, গম, চাল ও তেল কল এবং এসবের যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। দীর্ঘদিন তিনি কারখানাটি দক্ষতা ও সফলতার সাথে পরিচালনা করেন। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৯০৮ সালে) কুষ্টিয়াতে মোহিনী মিলস্ প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলে শিল্পবিপ্লব ঘটে যায়।
উইলিয়াম অ্যান্ড রেণউইক কোম্পানি ১৯৪১ সালে রেণইউক কারখানা প্রাইভেট লিমিটেড কারখানা হিসাবে আত্নপ্রকাশ করে। এখানে সে সময় আখ মাড়াই কল, আখের রস জ্বালানো বড় কড়াই, নলকূপ, চলকল, গম পেষা কল, তেল কল এবং এসবের যন্ত্রাংশ তৈরী হত।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের সময় কুষ্টিয়া প্রথক জেলা হিসাবে আত্নপ্রকাশ করে। দেশ ভাগের পর মি. দেশাই নাকম একজন মাদ্রাজি শিল্পপতি রেণউইক কারখানাটি ক্রয় করে নেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর রেণউইক মোম্পানির কারখানাটির প্রধান অফিস কুষ্টিয়া শহরে স্থান্তরিত হয়। অপরদিকে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপকে পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালের শুরুর দিকে কুষ্টিয়ার মজমপুরে ‘আলফালাক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নামে একটি বৃহদায়তন কৃষি সরঞ্জাম নির্মাণ করাখানা গড়ে উঠে। পঞ্চাশের দশকে কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায় হাজী জয়নাল পাঞ্জাবী ‘চালনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ ও মজমপুর গেটে আমজাদ হোসেন মিয়া ‘কশবা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে দুটি যন্ত্রপাতি নির্মাণ কারখানা গড়ে তোলেন। কারখানাগুলোতে আখ মাড়াই কল, নলকুপ এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরি করা হত।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেণউইক কারখানাটি জাতীয়করণ করা হয় এবং যজ্ঞেশ্বর কারখানাটি বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালে কোম্পানি দুটি একীভূত করে নামকরণ করা হয় ‘রেণইউক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং (বিডি)’।
এরপর কোম্পানিটিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তর করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর তালিকাভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার সংস্থাটির ৫১% শেয়ারের মালিক এবং অবশিষ্ট ৪৯% শেয়ার সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানায় রয়েছে।
স্বাধীনতার পর ‘রেণউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি’ বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন চিনিকলগুলোর জন্য মেশিন এবং যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করে। চিনিকলগুলোর মেশিন ও কলকব্জা মেরামতের ওয়ার্কশপ হিসাবেও ব্যহার করা হতো।
জাতীয়করণের পর হতে কোম্পানিটি ক্রমান্বয়ে লাভজনক খাত হতে লোকসানের মধ্যে পড়তে থাকে। চিনিকলগুলো লোকসান গুনতে থাকায় ও ক্রমান্বয়ে বন্ধ হতে থাকায় তাদের কাছে পাওনা বকয়া বাড়তে থাকে। অন্যদিকে কোম্পানির কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে ‘রেণউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি’ বন্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌচেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন মিলটি পরিচালনা করে আসছে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির একটি অংশ গড়াই নদীর তীরে বিনোদন পার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।