মীর মশাররফ হোসেন

মীর মশাররফ হোসেন

মীর মশাররফ হোসেন, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ। কারবালার যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত নাটক “বিষাদ সিন্ধু” তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম।

মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলা ২৮ কার্তিক ১২৫৪ বঙ্গাব্দে কুষ্টিয়া জেলার (ততকালীন নদীয়া জেলা) কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের গোড়াই তীরবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে। পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন পদমদী এস্টেটের জমিদার। মায়ের নাম দৌলতুন্নেছা।

পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় নিজগৃহে মুন্সির নিকট আরবি ও ফারসি সেখার মাধ্যমে। পরে গ্রামের জগমহন নন্দীর পাঠশালায় কিছুদিন পাঠগ্রহণ করেন। এরপর কুমারখালী এমএন স্কুল, কুষ্টিয়া হাইস্কুল ও পদমদী স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেন। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন। কিন্তু তার পড়াশোনা বেশিদুর অগ্রসর হয়নি।

মীর মশাররফ হোসেনের (Mir Mosharraf HossainA) কর্মজীবনঃ

মীর মশাররফ হোসেনের কর্মজীবন শুরু পিতার জমিদারী দেখাশোনার মধ্যদিয়ে । পরে ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হন।

ছাত্রজীবন হতে তার সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। কুমারখালীর আরেক কৃতি সন্তান গ্রামবার্তা সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন তার সাহিত্য গুরু। কবি ঈশ্বরগুপ্ত সম্পাদিত “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকায়ও তিনি সংবাদ প্রেরণ করতেন।

মীর মশাররফ হোসেন “আজিজননেহার” ও “হিতকরী” নামে দুইটি সংবাদপত্র সম্পাদনাও করতেন। কাঙ্গাল হরিনাথের “গ্রামবার্তা” পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তার পাশের গ্রামে আখড়া প্রতিষ্ঠা করায় লালন শাহের সাথেও তার সখ্যতা গড়ে ওঠে।

বাংলা সাহত্যের প্রথম উপন্যাস বঙ্কিম চন্দ্রের দূর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) প্রকাশের ৪ বছর পর ১৮৬৯ সালে মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম উপন্যাস রত্নাবতী প্রকাশিত হয়। মুসলিম সাহিত্যিকদের পতিকৃত মীর মশাররফ হোসেন আরব-ফারস মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানী বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ বাংলায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। কারবালার করুণ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত বিষাদ সিন্ধু বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মগ্রন্থের মতো শ্রদ্ধার সাথে পঠিত হয়।

নাটক ও আত্নজৈবনিক উপন্যাসাগুলোতে তিনি সকালীন সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যার উপর তীক্ষ কটাক্ষপাত করেন। ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিকায় তিনি রচনা করেন নাটক ‘জমিদার দর্পণ‘। উপমহাদেশে গোরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলামানের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান ছিল সে বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়ে তিনি ‘গো-জীবন‘ নামক প্রপন্ধ রচনা করেন। ১৮৮৯ সালে এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে তিনি সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হন। পরে প্রবন্ধটির আর কোন সংকলণ প্রকাশিত হয়নি।

মীর মশাররফ হোসেন গতিশীল গদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। একে একে তিনি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্নজীবনী, পাঠ্যপুস্তক, প্রহসন প্রভিতী রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলী হল- গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী-সেতু (১৮৭৩), বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩), এর উপায় কি (১৮৭৫), বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭), গো-জীবন (১৮৮৯), বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৯৮), নিয়তি কি অবনতি (১৮৮৯), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), তহমিনা (১৮৯৭), টালা অভিনয় (১৮৯৭),  গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯), মৌলুদ শরীফ  (১৯০৩), মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা (দুই ভাগ ১৯০৩, ১৯০৮), হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (১৯০৫), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫),  মদিনার গৌরব (১৯০৬), বাজীমাৎ (১৯০৮), আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০), আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম (১৯১০) ইত্যাদি।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রায় ৬৪ বছর বয়সে পদমদী নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। পদমদীতে স্ত্রী কুলসুমের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। ইহলোকে তিনি সশরীরে না থাকলেও তার কীর্তির মাঝে চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এই কথা সাহিত্যিক।


তথ্যঋণঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। বাংলাপিডিয়া

Scroll to Top