লাহিনীপাড়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার লাহিনীপাড়া নামক গ্রামে অবস্থিত। এটি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন এর বসতভিটা।
তিনি ১৯৮৭ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলা ২৮ কার্তিক ১২৫৪ বঙ্গাব্দে কুষ্টিয়া জেলার (ততকালীন নদীয়া জেলা) কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের গোড়াই তীরবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হল- গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী-সেতু (১৮৭৩), বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩), নাটক জমিদার দর্পণ (১৮৭৩), এর উপায় কি (১৮৭৫), বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭), গো-জীবন (১৮৮৯), বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৯৮), নিয়তি কি অবনতি (১৮৮৯), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), তহমিনা (১৮৯৭), টালা অভিনয় (১৮৯৭), গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯), মৌলুদ শরীফ (১৯০৩), মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা (দুই ভাগ ১৯০৩, ১৯০৮), হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (১৯০৫), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫), মদিনার গৌরব (১৯০৬), বাজীমাৎ (১৯০৮), আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০), বিবি কুলসুম (১৯১০) ইত্যাদি।
শেষ জীবনে তিনি রাজবাড়ী জেলার পদমদীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। পদমদীতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
মীরের পোত্রিক বাস্তভিটার প্রায় ৩২ বিঘা জমি বহু আগে থেকে বেদখল হয়ে ছিল। স্থানীয়রা মূল বাড়ীর কিছু অংশ উদ্ধার করে ১৯৯২ সালে মীর মশাররফ হোসেন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে। ১৯৯৫ সালে সেখানে স্থাপিত হয় মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
২০১০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঝে সরকারি অর্থায়নে একতলা এক কামরার পাঠাগার কাম অডিটোরিয়াম কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।

সরকারি যথাযথ উদ্যোগের অভাবে তার স্মৃতিচিহ্ন সেভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। কবির বংশধরদের একজনের প্রচেষ্টায় পারিবারিক ভাবে সংরক্ষিত কবির ব্যবহৃত বেশ কিছু আসবাবপত্র, তোজসপত্র, হাতে লেখা পান্ডুলিপি, বই ও ছবি সেখানে স্থান পেয়েছে। পাঠাগার নাম হলেও বিশাষসিন্ধুর একটি কপি ছাড়া সেখানে কবির লেখা আর কোন গ্রহ্ন নাই।
মীর মশাররফ হোসেন কবি পরিচয়রে বাইরে আরও একটি বড় পরিচয় তিনি গিতিকার। তার লেখা ১২১ টি গানের পান্ডুলিপি তার বংশধরদের সংরক্ষণে থাকলেও এখন তার সন্ধান পাওয়া যায়না। গানের কোন পান্ডলিপি তার বাস্তুভিটায় নাই। তার গান সরকারি বা বেসরকারি ভাবে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

১৯৯২ সালে তার মূল বাস ভবনের স্থানটুকু দখলদারদের নিকট হতে সরকার ক্রয় করে। ১৯৯৩ সালে সরকারি অর্থায়নে সেখানে তার নামে স্মৃতি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। বর্তমানে যা নবনির্মীত পাঠাগার কাম অডিটোরিয়ামের পেছনে অযন্ত অবহেলায় পড়ে আছে। স্মৃতি পাঠাগার ভবনের পাশে কবির ব্যবহৃত একটি পরিত্যাক্ত ইন্দারা বা কুয়া রয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় কিভাবে যাবেন?
কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে কুষ্টিয়া রাজবাড়ী মহাসড়ক ধরে ৩ কিলোমিটার পূর্বে গড়াই নদীর উপর নির্মিত সতুর টোল প্লাজা। টোল প্লাজায় প্রবেশের আগে “বিষাদ সিদ্ধুর রচিয়তা মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তভিটা” নামে একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। দক্ষিণ দিকে ৪০০ মিটার গেলে পশ্চিমে রাস্তার ধারে চার চালা ঘরের আদলে নির্মীত একটি গেট। গেটের ভেতরে একটি খেলার মাঠ যার উত্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উত্তর পশ্চিমে পাঠাগার কাম অডিটোরিয়াম ভবণ।
চার চালা ঘরের আদলে তৈরী গেট দিয়ে ঢুকলে রাস্তার দুই পাশে সিমেন্টের তৈরী তিন কোণা স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভের তিন পাশে কবির লেখা বিভিন্ন উক্তি খোদায় করা আছে। বামের প্রথম স্তম্ভে কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লেখা রয়েছে। লেখাগুলোও অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাস্তভিটাটি সরকারের প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন ও তত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। কবির জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে এখানে সরকারিভাবে তিন দিনের আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার আয়োজন করা হয়।