যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যয় ওরফে বিপ্লবী বাঘা যতীন
১৯০৭ সাল। জলপায়গুড়ী রেল স্টেশনে অসুস্থ এক সহযাত্রীর জন্য পানি আনতে যাবার পথে আচমকা এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের সাথে ধাক্কা লাগে এক বাঙ্গালী যুবকের। রেগে গিয়ে যুবকে বেত্রাঘাত করেন ও অশালীন ভাষায় বকাবকি করেন ওই ক্যাপ্টেন। পানি দিয়ে ফিরে এসে যুবক আবার ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি হন। ভারতীয়দের প্রতি এহন বিদ্বেশপূর্ণ আচরণের কারণ জানতে চান। ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে আবার মারতে উদ্যত হন। সাথে যোগ দেয় আরও তিন জওয়ান।
পরের ইতিহাস সকলের কমবেশি জানা। কয়েকমিনিটের মধ্যে ক্যাপ্টেন সহ চার ব্রিটিশ সেনাকে প্লাটফর্মে ফেলে জনতার সামনে বেতম উত্তম মাধ্যম দেন। ব্রিটিশ সেনাদের চোয়াল ভাঙ্গার দায়ে তার নামে মামলা হয়। সেই সময় ইংরেজ সামরিক কর্মকর্তাদের এক বাঙালি যুবকের কাছে নতি স্বীকার করা অত্যন্ত অপমানজনক ছিল। আর এই ঘটনা ব্রিটিশ শাসনের খ্যাতি কালিমালিপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিপুল সমালোচনার মুখে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন।
এতক্ষণ ধরে যার সাহসিকতার গল্প শুনছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। যিনি বিপ্লবী বাঘা যতীন নামেই বেশি পরিচিত।
বিপ্লবী বাঘা যতীন বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। যতীনের পৈতৃক নিবাস ছিল ঝিনাইদহ জেলার রিশাখালী গ্রামে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যতীন পিতৃহীন হন। কণ্যা বিনোদবালা ও যতীনকে নিয়ে তার মা কয়া গ্রামে পিতৃলয়ে চলে আসেন।
শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তি ও সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। ইতিহাস বলে শুধুমাত্র ছোট একটি ছোরা দিয়ে এক বাঘ হত্যা করেন। এ ঘটনার পর থেকে শক্তিমত্তার জন্য লোকমুখে তিনি “বাঘা যতীন” নামে পরিচিতি পান।
যতীন্দ্রনাথ শৈশবে কয়া গ্রামে প্রথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে মামা বসন্তকুমার চট্রোপাধ্যায়ের বাসায় থেকে কৃষ্ণনগরে এ ভি (এংলো ভার্নাকুলার) স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯৮ সালে এ ভি স্কুল হতে প্রবেশিকা পাশ করে কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজ (বর্তমানে ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) এ এফএ ভর্তি হন।
ক্ষুদিরাম বোস সেন্টাল কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। যতীন স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবতে শুরু করেন। বিবেকানন্দের পরামর্শে তিনি শরীর চর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন। সেখানে তার সাথে সে সময়ের অনেক স্বাধীনতাকামী বিশিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় ঘটে। শচীন বন্দোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়ের সুবাদে তার পিতা গোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাক্ষাৎ পান। যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালিয় বিপ্লবীদের জীবনী রচনা করেছিলেন।
সদ্য প্রচলিত টাইপ রাইটার ব্যবহারের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোটা মাইনের চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় যতীন অ্যাটকিনসন সাথেবের কাছে স্টেনো টাইপিং শেখেন। ১৮৯৯ সালে ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিতে পরিচালিত কলেজের পাঠ চুকিয়ে যতীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুর চলে যান।
মজফ্ফরপুর গিয়ে বিপ্লবী বাঘা যতীন ব্যারিস্টার কেনেডির সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। ব্যারিস্টার কেনেডি ছিলেন ভারতপ্রেমী। মোগল সাম্রাজ্যের উপর মৌলিক গবেষনার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। কেনেডির উৎসাহে যতীন মজফ্ফরপুরে যুবকদের জন্য ফুটবল ও এ্যাথলেটিক্স ক্লাব গঠন করেন। দূভাগ্যক্রমে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফল্ল চাকীর বোমায় কেনেডির স্ত্রী ও কণ্যার মৃত্যু ঘটে।
মায়ের অসুস্থতার কথা জেনে যতীন্দ্রনাথ কয়া গ্রামে ফিরে এসে দেখেন মা মৃত্যুবরণ করেছেন। কুমারখালীর উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে ইন্দুবালার সাথে তার প্রয়াত মা বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন বলে জানতে পেরে ১৯০০ সালে যতীন ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন।
যতীন মজফফরপুরে ফিরবেন না জেনে কেনেডি তৎকালীন বাংলা সরকারের অর্থসচিব বন্ধু হেনরি হুইলারকে যতীন সম্পর্কে লিখে পাঠান। হুইলার তাকে নিজের স্ট্যানোগ্রাফার হিসাবে নিযোগ দেন। যতীনের পেশাগত নৈপুণ্য, আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম হুইলারকে মুগ্ধ করে।
১৯০০ সালের দিকে অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে মিলে যতীন জেলায় জেলায় গুপ্তসমিতির শাখা পত্তন করেন। ১৯০৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়ীতে যাতায়াতকালে শ্রী অরবিন্দ্র ঘোষের সাথে বিপ্লবী বাঘা যতীনের পরিচয় ঘটে। অরবিন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে যতীন সরাসরি বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং যুগান্তর দলে যোগ দেন। এসময় যতীন শরীর গঠন, গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক চালানোর প্রশক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তোর দলে কাজ করতে গিয়ে বিপ্লবী নরেন রায়ের সাথে পরিচিত হন এবং অল্প সময়ে একে অপরের আস্থাভাজন হন।
১৯০৬ সালের শেষের দিকে যতীন স্বপরিবারে দেওঘরে বাস করতে থাকেন। দেওঘরে এসে বারীণ ঘোষের সাথে একটি বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে বারীণ কলিকাতার মানিকতলায় আরো বড় কারখানা খোলেন।
১৯০৭ সালে বিশেষ কাজে হুইলার দার্জিলিং স্থান্তরিত হলে যতীনও তার সাথে সপরিবারে দার্জিলিং চলে আসেন। এখানে এসেও যতীন অনুশলিন সমিতির গুপ্ত শাখা স্থাপন করতে থাকেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল সহ চারজন অফিসারের সাথে শিলাগুড়ি স্টেশনে যতীনের মারপিট হয় যার বর্ণনা প্রথম পরিচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে। চারজনের চোয়াল ভাঙ্গার অপরাথধে যতীনের নামে মামলা হলে সারাদেশে হই-চই পড়ে যায়। কাগজে এই নিয়ে লেখা লেখি হতে থাকে। চাপে পড়ে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।
হুইলার ঠাট্রার ছলে জানতে চান ‘আচ্ছা, একা কটা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?’ যতীন উত্তরে জানান “ভাল মানুষ হলে একটাও না;দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব।”
১৯০৮ সালে বিপ্লবী বাঘা যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীর নামে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হয়। সাক্ষ প্রমাণের অভাবে যতীনকে পরে এই মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। কিছুদিন পর যতীনসহ আরো কয়েকজন বিপ্লবীকে পুনরায় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়। অত্যাচারের শিকার হয়ে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন। সাক্ষ প্রমাণের অভাবে যতীন এই মামলা থেকেও মুক্তি পান।
অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে যতীন নিয়মিত বাদা অঞ্চলে গিয়ে কর্মীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ব্যয়ভার বহন, অস্ত্র সংগ্রহ সহ বিপ্লবের কাজে অর্থ সংগ্রহরে জন্য যতীন দুর্ধর্ষ কিছু স্বদেশী ডাকাতি করেন।
১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে বিপ্লবী বাঘা যতীনকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলায় জামিন পেয়ে কলকাতার দায়িত্ব অতুলকৃষ্ণ ঘোষের কাছে অর্পণ করে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে যতীন পৈতৃক ভিটা ঝিনাইদহে চলে আসেন। ঝিনাইদহে এসে যশোর-ঝিনাইদহ রেলপথ নির্মাণ উপলক্ষে যতীন ছদ্ম নামে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবার আড়ালে যতীন সাইকেল ও ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গুপ্তসমিতির শাখাগুলোকে উদ্বদ্ধ করতে থাকেন।
জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাবিত কাঠামোর বিরোধিতা করে “পূর্ণ স্বাধীনতা” অর্জনের জন্য নিবেদিত এক প্রাণ হয়ে উঠেন বাঘা যতীন। ১৯১২ সালে কলকাতা সফরকালে জার্মান যুবরাজের সঙ্গে যতীন দেখা করেন এবং তাঁকে ভারতে বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করেন। কৃপাল সিং নামক এক বিপ্লবীর বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে ইন্দো-জার্মান মিত্রদের পাঠানো অস্ত্রশস্ত্রসমেত জাহাজ সরকার আটক করে ফেলে।
অস্ত্রসশস্ত্র সহ জাহাজ আটকানোর পর বিপ্লবীদের শেষ করতে সরকার উঠে পড়ে লাগে। পুলিশ একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাশি চালাতে থাকে। গাঢাকা দেওয়ার পরিবর্তে যতীন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। দৃঢ়কন্ঠে জানালেন “আর পালায়ন নয়, যুদ্ধ করে আমরা মরব, তাতেই দেশ জাগবে।
যতীন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্রপাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে সাথে নিয়ে ১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গভীর জঙ্গলে কাটিয়ে সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছালেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকন্ঠে। সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন তারা।
ব্রিটিশ পুলিশের এক বিশাল ব্যাটালিয়ন চারদিক থেকে যতীনদের ঘীরে ফেলে। যতীনের নেতৃত্বে পিস্তল হাতে মাত্র ৫ জন বিপ্লবী টানা ২ ঘন্টা প্রতিরোধ করেন। ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী শহীদ হন। একপর্যায়ে যতীনের পেটে গুলি লাগলে। পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে বিপ্লবী বাঘা যতীন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালে মৃত্যুর আগমুহূর্তে যতীন হেসে বলেন-
“এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে প্রতিটি বিন্দু অর্পন করে গেলাম দেশমাতার চরণে।”
আরও পড়ুনঃ কুষ্টিয়ার ৮ বিপ্লবী