কুষ্টিয়ায় ভাষা আন্দোলন

কুষ্টিয়া জেলায় রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন

৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারী কুষ্টিয়া জেলা জুড়ে স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। হঠকারী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবীদ, শিক্ষক, ছাত্র সহ সাধারণ জনগণ। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের এই ঢেউ এসে পড়েছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়া জেলাতেও।

১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয় যা ছিল রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম মিছিল।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে পাকিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ট্রের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। খাজা নজিমুদ্দিন এই প্রস্তুবের বিরোধিতা করে বলেন “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক”। খাজা নজিমুদ্দিনের কথার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি পালিত হয়।

১৯৫১ সালের শেষের দিকে সারা বাংলাদেশের মত কুষ্টিয়াতেও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লাগে। এর আগে কুষ্টিয়াতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বেগবান করার লক্ষে ১৯৫০ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক জুলফিকার হায়দার তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে যোগাযোগ করেন। কেন্দ্রের পরামর্শে জুলফিকার হায়দারকে আহ্বায়ক করে তমদ্দুন মজলিসের কুষ্টিয়া শাখা গঠন করা হয় যার সদস্য করা হয় নজমউদ্দিন আহমেদ, সামসুজ্জোহা, জালালউদ্দিন খান প্রমুখ ব্যক্তিদের।

কুষ্টিয়ায় তমদ্দুন মজলিসের কমিটি গঠন

১৯৫১ সালে অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি ও নজমউদ্দিন আহমেদকে সেক্রেটারি করে কুষ্টিয়ায় তমদ্দুন মজলিসের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। সদস্য হন মুহা. সিরাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট চৌধুরী জালালউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার তালেব আলী, ই.টি ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল হক, খন্দকার তালেব আলী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসসহ কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক ও সাংস্কতিক কর্মী ও ছাত্র নেতাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন

১৭ তারিখের সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি হন ব্যরিস্টার আব্দুল হক ও সেক্রেটারি জুলফিকার হায়দার। সদস্য করা হয় নজমউদ্দিন আহমেদ, খালেকুজ্জামান, দেওয়ান আহমেদ, ডা. আব্দুল আজি, এ্যডভোকেট সাদ আহম্মেদ, শওকত আলী প্রমুখ।

ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। কুষ্টিয়ায় এই কর্মসূচী সফল করতে সংগ্রাম পরিষদ ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ২১ তারিখ সমগ্র কুষ্টিয়া জুড়ে স্বতঃস্ফূত ধর্মঘট পালিত হয়। মহিনী মিলস, রেণউক যজ্ঞেশ্বরসহ কুষ্টিয়ার সকল কলকারখানা বন্ধ থাকে।

মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা

আন্দোলনে উত্তাল কুষ্টিয়া

২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, শফিক, জব্বারদের আত্মোত্যাগের খবর কুষ্টিয়াতে পৌছালে কুষ্টিয়া শহর বিক্ষোবে উত্তাল হয়ে উঠে ।

দুপুর ১২ টায় কুষ্টিয়া শহরে শিক্ষার্থীদের মিছিল বের হয়। দুপুর ২ টায় আব্দুল হকের সভাপতিত্বে মিউনিসিপ্যাল স্কুল হলে জনসভায় মানুষের ঢল নামে।

২১ ফেব্রুয়ারির পর শহরের রাস্তাঘাট, অলি-গলির দেওয়াল পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। দেয়ালে লাল রক্তের বর্ণে লেখা ছিল “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।

২২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া শহরে হরতাল পালিত হয়। কুষ্টিয়া কলেজ, কুষ্টিয়া ইংরেজী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদী মিছিল বের করে।

২৩ ফেব্রুয়ারিও কুষ্টিয়া শহরে সর্বাত্নক হরতাল পালিত হয়। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল কুষ্টিয়া শহর উত্তাল করে তোলে। বিকালে ডা.মোহাম্মদ আবুল কাশেম আলীর সভাপতিত্বে কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রায় ২৫ হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে কুষ্টিয়া শহরে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল বাজারে অ্যাডভোকেট আব্দুল হকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই

কুষ্টিয়া শহরের বাইরে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচী

২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার ঘটনায় কুষ্টিয়া শহরের মত কুমারখালী, খোকসা ও পোড়াদহেও বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারী কুমারখালীতে বিক্ষোভ মিছিল শেষে স্থানীয় ইংরেজী বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জনাব মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া।

একই দিন খোকশাতেও স্বতঃস্ফূত হটতাল পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল শহরের রাস্তা অলি গলি প্রদক্ষিণ শেষে সৈয়দ আলতাফ আলীর সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

৫ মার্চ শিক্ষার্থীরা পোড়াদহ রেলওয়ে স্টেশনে হরতাল পালন করে। হরতালের সমর্থনে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল ৪ টায় মৌলভী খন্দকার মহিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় যেখানে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র জনতা অংশ গ্রহণ করেন।

সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্ম তৎপরতায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এতটায় বিস্তৃত হয়েছিল যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কুষ্টিয়া সফরের সময় কালো পতাকা সংবর্ধনার শঙ্কায় সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আব্দুল হক কে মেহেরপুরে এক্সটার্ন করানো হয় এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা এ্যডভোকেট সাদ আহমেদকে স্বগৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়। গ্রেফতার করা হয় কেনী রোডের শওকত আলীকে।

কেন্দ্রের নির্দেশে ১৯৫৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কুষ্টিয়ায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আব্দুল হকের সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কুষ্টিয়ার কৃতিসন্তান সাবেক মন্ত্রী ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য মাওলানা শামসুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এবং প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে তিরস্কার করে প্রাদেশিক পরিষদে ভাষণ দেন।

বাংলার প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও কুষ্টিয়ার মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

আরও পড়ুনঃ

কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা
কুষ্টিয়ার ৮ বিপ্লবী

Scroll to Top