রায়বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রুপকার। বাংলা নাট্যসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পর দীনবন্ধুর আবির্ভাব। যদিও তিনি মাইকেলের মত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। পরবর্তিকালে তিনিই হয়ে ওঠেন এই ধারায় নাট্যকারদের আদর্শস্থানীয়।
দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম
দীনবন্ধু মিত্র ১৮৩০ সালের ১ লা নভেম্বর তৎকালীন নদীয়া জেলার চৌবাড়ীয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। দীনবন্ধু অবশ্য তার আসল নাম নয়। এই নাম তিনি পরবর্তিতে ধারণ করেন। তার পিতৃদত্ত নাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ মিত্র।
দীনবন্ধুর শিক্ষাবীজন
দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু গ্রাম্য পাঠশালায়। সেখানে কিছুদিন পাঠগ্রহণের পর তার পিতা তাকে জমিদারের সেরেস্তায় মাসিক ৮ টাকা বেতনে কাজে নিযুক্ত করে দেন। দীনবন্ধু মিত্র বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাই তিনি কলকাতায় পালিয়ে আসেন।
প্রথমে তিনি নাম পরিবর্তন করে দীনবন্ধু মিত্র নামে রেভারেন্ড জেমস লং এর অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন। কলকাতায় পড়াশুনার খরচ জোগাতে তাকে গৃহভূত্যের কাজ করতে হয়েছে। পরে তিনি কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমান হেয়ার স্কুল) এ ভর্তি হন। সেখান থেকে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় পাশ করে ১৮৫০ সালে হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) এ ভর্তি হন। সকল পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। প্রত্যেকবার তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত হন।
দীনবন্ধু মিত্রের কর্মজীবন
দীনবন্ধু ১৮৫৩ সালে টিচারশিপ পরীক্ষায় কৃতকার্ হয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি কোথাও শিক্ষকতা করেছিলেন। ১৮৫৫ সালে তিনি ১৫০ টাকা বেতনে পাটনায় পোষ্টমাস্টার নিযুক্ত হন। পর্যায়ক্রমে ওড়িশা, নদীয়া ও ঢাকা বিভাগে কাজ করেন। পদোন্নিতি পেয়ে কলকাতায় সুপারিনটেন্ডেন্ট পোষ্টমাষ্টার হন।
রায়বাহাদুর উপাধি লাভ
লাসাই যুদ্ধের সময় দীনবন্ধু ডাকবিভাগের কাজে কাছাড়ে কর্মরত ছিলেন। এই সময় তার তদারকি কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। যদিও শুধুমাত্র বাঙ্গালী হওয়ার কারণে ডাকবিভাগের উচ্চস্তরের কর্মচারী হয়েও তিনি উপযুক্ত বেতন পাননি।
দীনবন্ধুর সাহিত্যকর্ম
শিক্ষাজীবনে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংস্পর্শে এসে কবিতা লেখার মাধ্যমে দীনবন্ধুর সাহিত্যকর্ম শুরু হয়। তার লেখা কবিতা সেসময় ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার প্রথম প্রকাশিত নাটক ‘নীলদর্পণ’ যা ১৮৬০ সালে লেখক পরিচয় বিহীন ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। নীলকরদের বীভৎস অত্যাচার ও নির্যাতনে লাঞ্ছিত অপমানিত দেশবাসঅ ও চাষীদের দুরাবস্থা এই নাটকে তুলে ধরেন। কর্মসূত্রে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার যে দক্ষতা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন তা তিনি ‘নীলদর্পণ’ নাটকে সার্থকভাবে তুলে ধরেন।
রেভারেন্ড জেস লঙ কর্তৃক ‘নীলদর্পন’ এর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে দেশ-বিদেশে ব্যপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। নীলকরদের সংগঠন ‘ল্যান্ড হোল্ডারস এ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন’ আদালতে নালিশ জানায়। আদালতের রায়ে জেমস লঙের জরিমানা ও কারাদন্ড হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ জরিমানার টাকা আদালতে তৎক্ষণাত পরিশোধ করে দেন।
‘নীলদর্পন’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রেরিত হয়। দেশে ও বিদেশে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে সরকার ইন্ডিগো কমিশন বা নীল কমিশন বসাতে বাধ্য হয়। কমিশনের সুপারিশে সরকার আইন জারি করেন ‘চাষিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীলচাষ নয়’।
নীলবিদ্রোহ ও সমসাময়িক বাংলার সমাজ ব্যবস্থার সাথে ‘নীলদর্পন’ নাটকের যোগাযোগ অত্যন্ত গভীর। নাটকটি ইংরেজী ভাষায় অনুদিত প্রথম বাংলা নাটক। নাটকটি অসংখ্যবার মঞ্চায়িত নাটক। এ নাটকের অভিনয় দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অভিনেতা কালীপ্রসন্ন সিংহের দিকে জুতো ছুঁড়ে মারেন।
নীলদর্পনের পর দীনবন্ধু মিত্র রুপকথা ভিত্তিক নাটক ‘নবীন তপস্বিনী’ রচনা বরেন যা তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্রপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন। নাটকটি ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও দীনবন্ধুর হাস্যরসাত্বক নাটক ‘কমলে-কামিনী’ ১৮৭৩ সালে ও সামাজিক নাটক ‘লীলাবতী’ ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয়।
দীনবন্ধু তিনটি প্রহসন রচনা করেন সুনাম অর্জন করেন। বিবাহবাতিগ্রস্থ বৃদ্ধের বিয়ে আয়োজন নিয়ে ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, সামাজিক বিপর্যয়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘সধবার একদশী’ ও হাস্যরস্ত্বক ‘জামাই বারিক’ প্রহসন তিনটিও প্রশংসিত হয়।
দীনবন্ধু মিত্রের দুইটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সুরধনী কাব্য ১ম ও ২য় ভাগ যথাক্রমে ১৮৭১ ও ১৮৭৬ সালে এবং দ্বাদশ কবিতা ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়।
দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু
১৮৭৩ সালের ১ লা নভেম্বর মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে এই মহান নাট্যকার মৃত্যুবরণ করেন।